শিম চাষ
বাংলাদেশে আনাচে কানাচে অনেক জাতের শিম চাষ হয়। এদের অনেকগুলো আঞ্চলিক নামে পরিচিত। শিমের ফুল ধারণের ভিত্তিতে (আগাম/নাবী) শ্রাবণ ও ভাদ্র মাসে বীজ বপন করতে হয়।
শিমের জাত ও ফুল ধারনের ভিত্তিতে
(ক) আগাম জাত ও ঝুম স্পেশাল, ঢাকাই মটর, আয়মী, মীরেশ্বরাই, বাটা, কুমিল্লা, সিলেট পার্পল, কার্তিকা, কাজলগৌরি ইত্যাদি।
(খ) নাবি জাতঃ কইভাজা, শ্বেতকন্যা, হাটহাজারী মাখন, সবুজ নলডগা, শিরডোরা নলডগা, ঘৃতকাঞ্চন, কন্যাসুন্দরী, হাতিরকান, কাশিমপুর গ্রীন, খৈয়া ইত্যাদি ।
জমি তৈরি ও সার প্রয়োগ
দেশি শিম সাধারণত মাদায় রোপণ করে বসতবাড়ির আশেপাশে, পুকুরপাড়ে, পথের ধারে, জমির আইলে, ছোট গাছে, চালায়/বেড়ায় উঠিয়ে দিয়ে চাষ করা হয়। ব্যবসায়িক ভিত্তিতে চাষের জন্য প্রথমে জমি চাষ ও মই দিয়ে সেচ, নিকাশের সুবিধার্থে পুরো জমি কয়েকটি খণ্ডে ভাগ করে নিতে হয়। ৩ মিটার দূরত্বে সারি করে সারিতে ১.৫ মিটার পর পর মাদায় ১.৫ মিটার চওড়া বেডের উপর ১মিটার ব্যবধানে জোড়া সারিতে ৩০ সেমি. পর পর গর্ত করে জমি তৈরি করতে হয়। সমস্ত জমিতে সার না দিয়ে মাদা বা গর্তে মৌল সার দিয়ে তা সমান করে রাখতে হয়। মাদা পদ্ধতির চাইতে বেড পদ্ধতিতে বেশি সংখ্যক গাছের সংকুলান হয়।
সার প্রয়োগ- শিম চাষের জন্য হেক্টর প্রতি ১০ টন গোবর সার, ১৫০ কেজি টিএসপি মৌল হিসেবে ৫০% শেষ চাষের সময় দিতে হয়। বাকী ৫০% মাদা বা গর্তের মাটিতে নিমোক্ত হারে মিশিয়ে দিতে হয়।
চারা গজানোর ১ মাস পরে ও গাছে ২/৪টি ফুল দেখা দেওয়ার পরে ২ কিস্তিতে ৫০ গ্রাম ইউরিয়া ও ৫০ গ্রাম করে এমওপি সার উপরিভপ্রয়োগ করতে হয়।
চারা রোপণ ও অতবর্তী পরিচর্যা
বীজ বপন ও বপনের সময়- মধ্য জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত। পারিবারিক বাগানে চাষে ৯০ সেন্টিমিটার চওড়া ও ৭৫ সেন্টিমিটার গভীর করে ২-৩ টি মাদা তৈরি করে নিয়ে মাদা প্রতি ৪-৫টি বীজ বুনলেই চলে। মাঠে চাষের জন্য ১.৬ মিটার চওড়া বীজতলা ৬ বেড তৈরি করে ১ মিটার দূরত্বে সারি করে সারিতে ১ মিটার দূরত্বে।
একইভাবে তৈরি মাদায় ৩-৪টি বীজ বপন করতে হয়। চারা গজালে মাদাপ্রতি ১-২টি সবল চারা রেখে বাকিগুলো তুলে ফেলতে হয়। বীজের হার ৪ হেক্টর প্রতি ৫-৭ কেজি।
অন্তবর্তী পরিচর্যা
শিম চাষে পানি নিস্কাশন ও বাউনির ব্যবস্থা করতে হয়। বাঁশের মাচায়, রশি দিয়ে তৈরি জালিতে ঘরের চালা, গাছের ডালপালায় উঠিয়ে দেয়া যায়। সারিতে গর্ত করে খুবরী করে চাষ করা হলে বাঁশের চটা বা কঞ্চি দিয়ে ইংরেজি 'এ' অক্ষরের ন্যায় কাঠামো তৈরি করে তাতে বাউনি দেওয়া যায়। মাদা পদ্ধতিতে চাষ করলে মাচা বা জাংলা করে দিতে হয়। চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা অঞ্চলে জমির আইলে বাঁশের আগা কঞ্চিসহ পুঁতে এবং যশোর ও ঝিনাইদহের কিছু এলাকায় পাতলা করে ধৈঞ্চা গাছ জন্মায়ে কৌশল করে শিমের গাছের বাউনি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। শিমের বীজ রোপণকালে গোড়ায় যাতে পানি জমতে না পারে সেদিকে বিশেষ খেয়াল রাখতে হয়।
পোকামাকড় ও রোগ দমন- বরবটি চাষে শিমের পোকা ও রোগ সম্পর্কে উল্লেখ করা হলো। কেননা এ দু ফসলের রোগ ও পোকার আক্রমণ প্রায় একই ধরনের।
পোকামাকড়- জাব পোকা এ পোকা শাখা ও শিমের রস শোষণ করে খায়। ম্যালাথিয়ন বা এফিডান ডাষ্টিং প্রয়োগ করে দমন করা যায়।
মাকড়- মাকড় পাতা, ডগা ও শিমের রস চুষে খায়। ফেনিট্রোথিয়ন ৫০ তরল ১ মিলি লিটার হিসেবে ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হয়।
পাতা খাদক- শুয়া পোকা পাতা খেয়ে ঝাঁঝরা করে ফেলে। ডায়াজিনন বা সাইপারমেথ্রিন তরল ২ মিলি লিটার প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ১০ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে হয়।
রোগ- কাণ্ড পচা-বর্ষাকালে ছায়াযুক্ত স্থানে ছাতা রোগে কাও পচে এবং গাছ মারা যায়। বোর্দোমিক্সার বা কপার ঘটিত বালাইনাশক ১৫ দিন পর পর ২ বার স্প্রে করতে হয়। পানি নিকাশ ও শুকনা চাষ অবস্থা তৈরি করতে হয়।
সেচ ও নিকাশ- শিম চাষের জন্য দোঁআশ ও বেলে দোঁআশ মাটি সবচেয়ে ভালো। কিন্তু শিমগাছ দাঁড়ানো পানি মোটেই সহ্য করতে পারে না। ভালো নিকাশ ব্যবস্থাসহ ছায়াযুক্ত জমি ভালো। নদীর তীরবর্তী পলি মাটিতে ভালো ফলন দেয়। ফুল ও ফল ধরার সময় প্রচুর রসের প্রয়োজন হয়। তাই এ সময় সেচ দেয়ার ব্যবস্থা রাখলে ভাল ফলন পাওয়া যায় ।
ফসল সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণ
শিম ধাপে ধাপে সগ্রহ করতে হয়। জাতভেদে কার্তিক-চৈত্র মাস পর্যন্ত শিম সংগ্রহ করা যায়। পরিপুষ্ট সবজি সংগ্রহ করে ঠান্ডা ও আর্দ্র অবস্থায় রাখতে হবে। ছালার বস্তা, কাগজের কার্টুন বা বাঁশের খাঁচায় খড় বা কাঁচা পাতা দিয়ে স্তর করে তাতে ১০-২০ কেজি শিমের প্যাকেট করে দূরে পাঠানো যায়। তবে প্যাকেট ঠান্ডা পরিবেশে করলে বেশি ভালো হয়। কাছের বাজারের জন্য ডালা বা ভারায় করে মাথায় /ভ্যানের সাহায্যে নেয়া যায়।
ফলন হেক্টর প্রতি ১৫-২০ টন হয়।
বরবটির চাষ
বরবটির জাত
বাংলাদেশে দীর্ঘদিন যাবৎ দেশি ও চায়নিজ জাতের বরবটি চাষ হচ্ছে। দেশি জাত- পুষা বর্ষাতি, পুষা ফালগুনী, ঘৃতসুন্দরী, বনলতা, লালবেনী ইত্যাদি। চায়নিজ জাত-কেগরনাটকি, ইয়ার্ড লং, গ্রীন লং, তকি, সামুরাই এফ-১ ইত্যাদি ।
জমি তৈরি ও সার প্রয়োগ
প্রায় সব ধরনের মাটিতে বরবটি চাষ করা যায়। তবে দোঁআশ এবং বেলে দোঁআশ মাটি সবচেয়ে বেশি উপযোগী। জমি ভালোভাবে ৪/৫টি চাষ ও মই দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করে কোদাল দিয়ে আইল বানাতে হবে। বরবটি গাছ দাঁড়ানো পানি সহ্য করতে পারে না। বরবটি চাষে মাদা পদ্ধতি তেমন সুবিধাজনক নয় । আইল তৈরি করে তাতে বীজ রোপণ করে ইংরেজি 'এ' অক্ষরের মত কাঠামো করে বাউনি বানাতে হয়।
আইলের আকারঃ দৈর্ঘ্যে ২২ মিটার ও প্রস্থে ৪৫ সেন্টিমিটার করতে হয়। দৈর্ঘ্য প্রয়োজন বড় করা যাবে। আইল উঁচু অথবা মাঝারি উঁচু এবং চওড়া করতে হয়। পানিতে ডুবে না এবং স্যাঁতসেঁতে থাকে না এমন আইল নির্বাচন করতে হয়।
আইল তৈরিঃ পুরাতন আইলের ক্ষেত্রে কোদাল দিয়ে কুপিয়ে আগাছা পরিষ্কার করে নির্দিষ্ট দূরত্বে খুবরি বা মাদা তৈরি করতে হয় । তবে নতুন করে উঁচু করা আইল সম্পূর্ণ না কুপিয়ে শুধু গর্ত প্রস্তুত করলেই চলে (আইলে বীজ রোপণের গর্ত হচ্ছে খুবরি)।
সারের পরিমাণ ও প্রয়োগ ৪ আইল প্রতি নিচে উল্লেখিত হারে সার প্রয়োগ করা দরকার।
সারের নাম | হেক্টর প্রতি সারের পরিমাণ |
গোবর/কম্পোস্ট | ১০-১৫ টন |
ইউরিয়া | ৩০ কেজি |
টিএসপি | ২৫ কেজি |
এমওপি | ২৫ কেজি |
সার ব্যবহারের নিয়মঃ এমওপি ও ইউরিয়া সার ব্যতিত সম্পূর্ণ গোবর ও টিএসপি সার আইল তৈরির সময় সম্পূর্ণ জমির মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হয় অথবা মাদায় প্রয়োগ করতে হয়।
সারের উপরিপ্রয়োগ- মৌল সার ব্যতিত উপরি প্রয়োগের সারের পরিমাণ ও নিয়ম নিচে দেয়া হলো ।
সার ব্যবহারের সময় | সারের নাম ও পরিমাণ/মাদা/খুবরি | |
ইউরিয়া | এসওপি | |
উপরি প্রয়োগ : বীজ স্বপনের ১৫-২০ দিন পর | ৫০ গ্রাম | ২৫ গ্রাম |
২য় উপরি প্রয়োগ ও বীজ বপনের ৩০-৩৫ দিন পর | ৫০ গ্রাম | ২৫ গ্রাম |
আইলের মাঝখানে খুঁটি দিয়ে লম্বালম্বি করে লাইন টেনে সেখানে সার দিয়ে মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হয় অথবা গাছের চতুর্দিকে গোল করে খুঁড়ে নিয়ে তাতে সার প্রয়োগ করতে হয়।
চারা রোপণ ও অন্তবর্তী পরিচর্যা- বীজ রোপণের সমর ফেব্রুয়ারি-জুলাই মাস। তবে মার্চ-এপ্রিল মাস বীজ রোপণের উপযোগী সমর। বীজ রোপণের ৩-৫ দিনে চারা বের হয়।
বীজ রোপণের দূরত্বঃ এক পাছ থেকে আরেক গাছের দূরত্ব ২০-২৫ সেন্টিমিটার। সাধারণত, আইলে এক সারি পদ্ধতিতে বরবটি চাষ করা হয়। তবে আইল অধিক চওড়া হলে দুই সারি পদ্ধতিতে চাষ করা যায়। বীজ বপনের গভীরতা হলো ২-৩ সেন্টিমিটার।
মালচিং : রবি মৌসুমে জমির আর্দ্রতা সংরক্ষণ ও আগাছা নিরন্ত্রণের জন্য খড়কুটা, লতাপাতা অথবা শুকনো কচুরিপানা ইত্যাদি দিয়ে মালচিং করলে ভালো হয়।
চারা পাতলাকরণ ও শূন্যস্থান পূরণ : প্রতি মাদার সর্বোচ্চ ২টি চারা রাখাই বাঞ্ছনীয়। সুতরাং চারা ৪-৫ পাভা। বিশিষ্ট হলে ২টি সুস্থ সবল চারা রেখে বাকি চারা তুলে ফেলতে হয়। প্রয়োজনে শূন্যস্থান পূরণ করতে হয়। চারা ১৫-২০ সেমি. লম্বা হলে বাউনি দিতে হয়।
আগাছা দমন : চারা গজানোর পর থেকেই হাতের সাহায্যে ছোট ছোট আগাছা উঠিয়ে ফেলতে হয়। বীজ বপনের ২০-৩০ দিন পর্যন্ত কোনো আগাছা জমিতে থাকতে দেওরা যাবে না।
মাটি আলগাকরণঃ আগাছা নিড়ানির সময় আইলের মাটি নিড়ানি দিয়ে ভালোভাবে ঝুরঝুরে করে দিতে হয়। লক্ষ্য রাখতে হয়ে যেন মাটি আলগাকরণের সময় গাছের শিকড় ক্ষতিগ্রস্থ না হয়। সার প্রয়োগের পর মাটি আলগাকরণের কাজ করতে হয়।
গাছের গোড়ায় মাটি দেয়াঃ আগাছা দমন ও সারের উপরি প্রয়োগের সময় গাছের গোড়ায় মাটি দিতে হয়।
খুঁটি দেয়াঃ গাছ লতাতে শুরু করলে যাতে ভালোভাবে বিস্তার লাভ করতে পারে সে জন্য ১৫-২০ সেন্টিমিটার লম্বা হলেই বাঁশ বা বাঁশের কঞ্চি অথবা কাঠি দিয়ে খুঁটি দিতে হয়।
পোকামাকড় ও রোগ দমনঃ পোকা দমন- জাবপোকা দমন: জাবপোকা দলবদ্ধভাবে গাছের কচি পাতা ও ডগা, ফুল ও ফলের বোঁটা এবং ফলের রস চুষে খেয়ে ক্ষতি করে। এর আক্রমণের ফলে গাছ দূর্বল হয়ে যায় । আক্রান্ত গাছ ফুল দিতে পারে না। অনেক সময় ফুলের কুঁড়ি ও কচি ফল ঝরে পড়ে। জাবপোকা মোজাইক ভাইরাসের বাহক হিসেবে কাজ করে।
বিছাপোকাঃ বিছাপোকা বরবটি গাছের পাতার সবুজ অংশ খেয়ে ক্ষতি করে থাকে। আক্রমণের ফলে পাতার শিরাগুলো শুধু থেকে যায়। গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়, ফলন কম হয়।
শিমের মাছি পোকাঃ শিমের মাছি পোকা আক্রমণের ফলে গাছের বৃদ্ধি কমে যায়। গাছ হলুদ রঙের হয়ে পড়ে। মাটির সামান্য উপরে গাছের কাণ্ড মাটো হয়ে যায়। গাছ লম্বালম্বি কাটলে কাণ্ডের ভিতর শুককীট অথবা মূককীট দেখা যায়। আক্রান্ত গাছ মরে যায়।
থ্রিপসঃ এ পোকা পূর্ণাঙ্গ এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় জাবপোকার মতো গাছের কচি পাতার রস চুষে খেয়ে গাছের ক্ষতি করে। আক্রমণের ফলে ফুল ঝরে যায়।
ফলের মাজরা পোকাঃ পোকার কীড়া বরবটি গাছের কাণ্ড, মুকুল এবং ফল ছিদ্র করে নষ্ট করে দেয়। কীড়া আক্রান্ত ফলের বীজ ও শাঁস খেয়ে ক্ষতি করে। আক্রান্ত ফল খাওয়ার অযোগ্য হয়ে পড়ে। রোগ দমন- নেতিয়ে পড়া রোগ দমন : বীজ বপনের পর থেকে চারা অবস্থায় এ রোগের আক্রমণ হয়। এ রোগের আক্রমণে আক্রান্ত বীজ পচে যায়। চারারগোড়া চিকন, লিকলিকে হয়ে ধ্বসে পড়ে ও গাছ মারা যায়।
পাউডারি মিলডিউঃ এ রোগ হলে পাতা ও গাছের গায়ে উপরের দিকে সাদা পাউডারের মতো আবরণ দেখা যায়। আক্রমণের মাত্রা খুব বেশি হলে গাছ ফ্যাকাশে হয়ে মারা যায়।
হলুদ মোজাইকঃ পাতায় হলদে সবুজের ফোটা ফোটা নকশা দেখা যায়। পরে ধীরে ধীরে পাতা হলদে হয়ে যায়, পাতার আকারের বিকৃতি ঘটে এবং আয়তনে ছোট হয়। আক্রান্ত গাছগুলোর বৃদ্ধি ব্যাহত হয়, ফলে গাছ ছোট হয়, ফল কম ধরে এবং মাটিতে বীজের সংখ্যা কম হয়।
অ্যানথ্রাকনোজঃ রোগের জীবাণু প্রথমে পাতায় আক্রমণ করে। পাতায় বিভিন্ন আকারের দাগ পড়ে, স্বাভাবিক অবস্থায় পাতার ক্ষতি হয় সীমিত। পাতা থেকে ফলে আক্রমণ হয়। কচি অবস্থায় আক্রমণ হলে গোটা ফলটির ক্ষতি হতে পারে। আক্রমণ দেরিতে হলে ফল ছোট হয় এবং পঁচে যায়।
শেঁকড় পঁচা বা গোড়া পঁচাঃ এ রোগ চারা অবস্থা থেকে গাছের পরিণত অবস্থা পর্যন্ত দেখা যেতে পারে। এই রোগের আক্রমণে পাতার ক্ষতি হয় সীমিত। পাতা থেকে ফলে আক্রমণ হয়। কচি অবস্থায় আক্রমণ হলে গোটা ফলটির ক্ষতি হতে পারে। আক্রমণ দেরিতে হলে ফল ছোট হয় এবং পঁচে যায়।
সেচ ও নিকাশঃ গাছের গোড়ায় যাতে পানি দাঁড়াতে না পারে সেজন্য আইল উঁচু করতে হয়। জমির 'জো বুঝে ডালপালা ছাড়তে থাকলে এবং ফুল শুরু হলে সেচ দিতে হয়। সেচের পানি দ্রুত গড়িয়ে বের হতে পারে সে ব্যবস্থা করতে হয়।
ফসল সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণঃ বীজ বপনের ৪০-৫০ দিনের মধ্যেই বরবটি সগ্রহ শুরু করা যায়। কচি বরবটি খুব সাবধানে হাত দ্বারা অথবা ধারালো ছোট খুর বা কাঁচি দিয়ে বোঁটাসহ কেটে সগ্রহ করতে হয়। ফল ধরার ৪-৫ দিনের মধ্যেই বরবটি সগ্রহ করার উপযোগী হয়। বরবটি সংগ্রহ ও বাছাই করে মোঠা বেঁধে (১ কেজি) পলিথিন মাড়েকে পুরে বাজারে পাঠানো উচিত। হেক্টরপ্রতি ১০-১২ টন পর্যন্ত ফলন হতে পারে ।
ঢেঁড়শের জাতঃ বারি ঢেঁড়শ-১, ইপসা ঢেঁড়শ-১, আলেয়া, নিরিবিলি, গ্রীণ স্টার, প্রিন্স, হাই সফট, সিরাজউদ্দৌলা, লাকি-৭ ইত্যাদি। এছাড়াও আরও কয়েকটি উন্নত জাতের ঢেঁড়শ চাষাবাদ হচ্ছে। যেমন: পেন্টাগ্রিন, অনামিকা, পুষ শাওনী, পার্বণি কান্তি, বর্ষাতি, লাল ঢেঁড়শ ইত্যাদি। বিভিন্ন এলাকায় কিছু কিছু স্থানীয় জাত বিদ্যমান। যেমন: পুস, সুলকমাটি, টি-১, টি-২, টি-৩, টি-৪। তবে বাংলাদেশে যে সমস্ত জাত চাষ হচ্ছে তার মধ্যে ওকে ০৯৮৫ জাতটি মোজাইক ভাইরাস রোগ কম আক্রান্ত হয়।
জমি তৈরি ও সার প্রয়োগ
সারাদিন সুর্যের আলো পড়ে এমন জমি ৪/৫টি চাষ ও মই দিয়ে উঁচু নিচু সমান করতে হয়। সেঁচ নিকাশের সুবিধা করে বেড তৈরি করতে হয়। কেননা জমিতে পানি বেঁধে থাকলে ভাইরাস রোগ বিস্তার লাভ করে। বেডগুলো সাধারণত উত্তরে-দক্ষিণে লম্বা লম্বি করতে হয়।
সারের নাম | প্রতি শতক জমিতে প্রদানকৃত সারের পরিমাণ |
পঁচা গোবর সার | ৭৫-৮০ কেজি |
খৈল (পচা) | ২ কেজি |
ইউরিয়া | ২৩০-২৪০ গ্রাম |
টিএসপি | ৩৫০-৩৬০ গ্রাম |
এমওপি | ২৩০-২৪০ গ্রাম |
জমি তৈরির সময় গোবর, খৈল ও টিএসপি সম্পূর্ণ মৌল সার হিসেবে শেষ চাষের পূর্বে প্রয়োগ করতে হয়। চারা ২০-২৫ সেমি. লম্বা হলে পাছের গোড়া হতে ১২-১৫ সেমি. দুর দিয়ে বৃত্তাকারে ৩-৪ সেমি. গভীর করে নালা কেটে তাতে ইউরিয়া ও এমওপি সার প্ররোগ করে মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হয়।
চারা রোপণ ও অন্তবর্তী পরিচর্যা
জমি চাষের পর মাদা বা আইল তৈরি করে নির্দিষ্ট দূরত্বে বীজ রোপণ করতে হয়। প্রতি মাদায় ২-৩টি বীজ বপন করতে হয়। বীজ বপনের পূর্বে ২৪ ঘন্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখলে তাড়াতাড়ি গজায়। মাদা বা আইলের দূরত্ব হতে হবে ৫০x৫০ সেমি. । অর্থাৎ লাইন ও চারার মধ্যে উত্তর দিকে দূরত্ব হবে ৫০ সেমি.। বীজ ১-২ সেমি. গভীরে স্থাপন করলে ৪/৫ দিনে চারা বের হয়। চারার বয়স ৮/১০ দিন হলে প্রতি মাদায় ১টি সুস্থ ও সবল চারা রেখে অন্যগুলো উঠায়ে দিতে হয়। তবে গাছ হতে গাছের দূরত্ব ৪৫ সেমি. পর্যন্ত রাখা যায়। জমি তৈরির সময় আইলগুলো যেন চওড়া হয়, তাতে পানি নিকাশের সুবিধা হয়। আইলের গ্রন্থ ৪৫ সেমি. করে তা কুপিয়ে নরম ও ঝুরঝুরে করতে হয়।
অন্তবর্তী পরিচর্যাঃ গাছের প্রাথমিক বৃদ্ধির সময় নিড়ানি দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করে মাটির উপরিভাগ আগলা করে দিতে হয়। মাঝে মাঝে হালকা সেচ দিয়ে 'জো' অবস্থায় কোদাল দিয়ে পাতলা করে কুপিয়ে দিয়ে চটা মাটি ভেঙ্গে দিতে হয়।
আগাম হিসেবে ঢেঁড়শ চাষ করলে পানি সেচ দিতে হয়। মাটির প্রকারভেদে ১০-১৫ দিন পর পর সেচ দেয়ার প্রয়োজন হয়। বর্ষাকলে গাছের বৃদ্ধি যাতে ঠিকমত হতে পারে সেজন্য ২৫-৩০ সেমি. উঁচু করে বেড় করে দিতে হয়। অন্যথা পানি জমে গাছের ক্ষতি করতে পারে।
পোকামাকড় ও রোগদমন
পোকা দমন
এক প্রকারের ভয়াপোকা শুককীট কচি কাণ্ডে ছিদ্র করে ঢুকে পড়ে ও গাছের ক্ষতি সাধন করে। এর দমনের জন্য শতকরা কার্বোসালফান ২০ ইসি বেশ কার্যকর। ব্যবহারের পরে অন্তত ১০ দিন পর্যন্ত পাছের ঢেঁড়শ ব্যবহার করা উচিত নয়।
জ্যাসিড পোকাঃ এ পোকা গাছের পাতার রস চুষে খায় এবং ভাইরাস রোগ ছড়ায়। পোকার আক্রমণে পাতায় ছোট ছোট হলদে সালাটে দাগ পড়ে। এর আক্রমণে ফলন অনেক কমে যায়। এ পোকা দমনে ২ মিলি. জোলন/নগস ১লি পানিতে মিশিয়ে পাতার নিচে স্প্রে করতে হবে।
পাতা মোড়ানো পোকাঃ পোকার কীড়া পাতা মুড়ে তার ভিতরে বাস করে এবং পাতার সবুজ অংশ খেয়ে নষ্ট করে ফেলে। এজন্য ম্যালাথিয়ন ১.৯২ মিলি/লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। ডগার কাণ্ড ও ফল ছিদ্রকারী পোকা ও প্রজাপতি গাছের কাণ্ড বা ফলের পায়ে ডিম পাড়ে। ডিম থেকে কীড়া বের হয়ে গাছে কচিকাও এবং ফল ছিদ্র করে ঢুকে পড়ে এবং সেইসব অংশ কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। এক সময় কচি ডগা শুকিয়ে যায়। এর ফলে ফলন কমে যায়। এজন্য আলফা সাইপারমেট্রিন, ল্যামডা সাইহ্যালোথ্রিন ১-১.২ মিলি/লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হয়।
রোগ দমন- মোজাইক ভাইরাস : এ রোগে ঢেঁড়সের পাতা হলুদ ও সবুজ মোজাইকের মতো দেখা যায়। পাতা কুঁকড়ে যায়। রোগাক্রান্ত গাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করা যাবে না। এ্যাফিড/জ্যাসিড পোকা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এ রোগ দমন করা যায় ।
উইল্ট রোগঃ ছত্রাকের আক্রমণে গাছ হলদে ও বামণাকৃতির হয় এবং পরে গাছ ঢলে পড়ে। ফরমালিন বা ক্লোরোপিন দ্বারা মাটি শোধন করে এ রোগ দমন করা যায়।
গোড়া ও কাণ্ড পচা রোগ : এ রোগের আক্রমণে মাটি সংলগ্ন গাছের নরম হয়ে পড়ে যায়। আক্রান্ত শিকড়ে এবং কাজে কালো বর্ণের দাগ পড়ে। ডায়াথেন এম-৪৫, রিডোমিল/ কপার ঘটিত ছত্রাকনাশক দ্বারা এ রোগ দমন করা যায়।
পানি সেচ ও নিকাশ : শুষ্ক ঋতুতে ঢেঁড়শের চাষ করলে বীজ বপনের পর থেকে নিয়মিত পানি সেচের ব্যবস্থা করতে হয় । গাছের বৃদ্ধি স্তিমিত হলে ঢেঁড়শ দ্রুত শক্ত হয়ে যায়। নিয়মিত সেচ দেওয়া সম্ভব না হলে, খড়, ঘাস, কচুরিপানা দিয়ে মাটি ঢেকে (মালচ) রাখতে হয়, তাতে রস সংরক্ষণ হয়। ঢেঁড়শের জমিতে পানিভেজা বা স্যাঁতসেতে অবস্থা থাকলে সারের উপরি প্রয়োগ করলে ক্ষতি হয়। জমিতে বৃষ্টির পানি জমার সম্ভাবনা থাকলে আগে হতেই দু সারির মাঝখান দিয়ে নালা কেটে পানি বের করার ব্যবস্থা রাখতে হয়।
ফসল সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণ
ফসল সংগ্রহ ও গাছের একমাস বয়সের মধ্যে ঢেঁড়শের ফুল দেখা দেয়। ফুল আসার ৫-৬ দিনের মধ্যেই ফল সংগ্রহের উপযোগী হয়ে উঠে। একবার বাগানের ঢেঁড়শ সংগ্রহ শুরু হলে হলে গেলে প্রতিদিনই তোলার প্রয়োজন হয়। ঘন ঘন ঢেঁড়শ তুললে ফলন বেশি হয়। ঢেঁড়শ উঠানোর পর গরমে, রোদে বা শুল্ক পরিবেশে রাখলে খুব তাড়াতাড়ি মান নষ্ট হয়ে যায়। তাই বিকালে উঠায়ে রাত্রে শিশিরে রেখে দিয়ে ভোরে বা ভোরে উঠায়ে সাথে সাথে ছালার বস্তায় প্যাক করে বাজারে প্রেরণ করতে হয়। তবে ১৫-২০ ডিগ্রী সে. তাপমাত্রা ও ৮৫% আর্দ্রতায় ৩/৪ দিন সংরক্ষণ করা যায়।
ফলন- হেক্টরপ্রতি ৮-১০ টন।
এক কথায় উত্তর
১. শিমের একটি আগাম জাতের নাম লেখ ।
২. শিম চাষে হেক্টর প্রতি কত কেজি বীজ লাগে? ৩. শিমের জাব পোকা কী দিয়ে দমন করা যায় ?
৪. কেগরনাটকি কোন দেশের বরবটির জাত?
৫. বরবটির একটি রোগের নাম লেখ।
৬. ওকে ০৯৮৫ জাতের ঢেঁড়শ কোন রোগ প্রতিরোধী ?
৭. জ্যাসিড পোকা কোন রোগ ছড়ায় ?
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১. ফুল ধারনের ভিত্তিতে শিমের জাতগুলো উল্লেখ কর ।
২. বরবটি চাষে সারের মাত্রা উল্লেখ কর।
৩. বরবটি একটি রোগ ও একটি পোকার আক্রমণ ও দমন সম্পর্কে লেখ ।
৪. ঢেঁড়শ চাষে জমি তৈরি ও সার প্রয়োগ সম্পর্কে লেখ।
রচনামূলক প্রশ্ন
১. শিম চাষে সার প্রয়োগ, অন্তবর্তী পরিচর্যা ও ফসল সংগ্রহ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা কর ।
২. বরবটি চাষে চারা রোপণ ও অন্তবর্তী পরিচর্যাসহ তিনটি রোগ ও তিনটি পাকার আক্রমণ ও দমন সম্পর্কে বর্ণনা কর ।
৩. ঢেঁড়শ চাষে জমি তৈরি ও সার প্রয়োগসহ চারা রোপণ ও অন্তবর্তী পরিচর্যা সম্পর্কে বর্ণনা কর।
আরও দেখুন...